পনেরোটি নিম্নচাপের পর ধেয়ে এসেছিল ৫টি ঘূর্ণিঝড়, শুধু বাংলাদেশেই মৃত ১৪ হাজার, ঘরহারা ২ লক্ষ

পনেরোটি নিম্নচাপের পর ধেয়ে এসেছিল ৫টি ঘূর্ণিঝড়, শুধু বাংলাদেশেই মৃত ১৪ হাজার, ঘরহারা ২ লক্ষ

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব যে কতটা ভয়াবহ হয়ে পারে, ষাটের দশকে তা টের পেয়েছিলেন বাংলাদেশের বাসিন্দারা। এক মাসের মধ্যে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল তাঁদের জীবন। শুধু মাত্র ১টি দ্বীপেই মারা গিয়েছিলেন চোদ্দ হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে যে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছিল কুড়ি হাজারে। ঘরহারা হয়েছিলেন ২ লক্ষ বাসিন্দা।

১৯৬০ সালে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ৫টি ঘূর্ণিঝড়। তার মধ্যে ২টি ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আজকের আর্থিক মূল্যে ১৩ হাজার ৭৭৪ ব্রিটিশ পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় যা ১৩৭৭ কোটি ৪৮ লক্ষ ৩৭ হাজার ৬৬৮ টাকা।

সে বছর পর পর ঘূর্ণিঝড়ের আগে বঙ্গোপসাগরের উপর মোট পনেরোটি নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছিল। আবহবিদদের মতে, ওই নিম্মচাপগুলির পরেই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশে।

ষাটের দশকে মোট ৫টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পর পর ২টি দুর্যোগের সাক্ষী থেকেছিল বাংলাদেশের সন্দ্বীপ দ্বীপ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

সে বছর চিন এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামেও ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল। ৯ অক্টোবর ওই দু'টি দেশে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছিল। প্রতি ঘণ্টায় ১৫৩ কিলোমিটার গতিবেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গিয়েছিল ওই দুই দেশেই উপর দিয়ে।

সে দিন ওই দুই দেশ পার করে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে গিয়েছিল। সেখানে তার রূপ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল, ওই ঘূর্ণিঝড়ের জেরে ১৯ ফুটের সামুদ্রিক ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। যার জেরে বহু এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফলে ঘূর্ণিঝড়ে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার খতিয়ান সংগ্রহ করতেও বেগ পেতে হয়েছিল প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের।

একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের রামগতি দ্বীপে ৩,৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই সঙ্গে ৩৫ হাজার ঘরবাড়িও ভেঙে গিয়েছিল। ওই দ্বীপের ৯৫ শতাংশ কাঠামোই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়টি।

এ তো ছিল প্রাথমিক পরিসংখ্যান। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছিল বলে জানিয়েছিল প্রশাসন। মোট ৬ হাজার বাসিন্দার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়টি।

এখানেই শেষ নয়। মাসখানেকের মধ্যে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ফিরে এসেছিল ঘূর্ণিঝড়। পরিসংখ্যান জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে ঘনীভূত হওয়া দশ নম্বর নিম্নচাপটিই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

২৬ অক্টোবর ওই নিম্নচাপের জেরে প্রতি ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে ঝোড়ো হওয়া বয়ে যায়। অনেকের দাবি, হাওয়ার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১৭ কিলোমিটার।

২৬ সেপ্টেম্বরের ঠিক তিন সপ্তাহ আগেই বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড়। তার ক্ষত মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরও একটি ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সব কিছু।

ওই ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ২০ ফুটের ঢেউ উঠেছিল। যাতে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের উপকূলবর্তী প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা।

ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সমুদ্রের তীরে। তার একটি নাকি প্রায় ৪০ ফুটের ছিল।

ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে ছিল চট্টগ্রাম। প্রায় ১০ ফুট জলের তলায় চলে দিয়েছিল ওই জেলা। চট্টগ্রাম বন্দরটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ঝড় শেষে দেখা যায়, বন্দরের সমস্ত নৌকা গিয়ে ছিটকে পড়েছে তীর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে।

চট্টগ্রামের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সন্দ্বীপ দ্বীপ। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘণ্টায় ২৪১ কিলোমিটার গতিতে ঝোড়ো হাওয়া বয়েছিল বলে দাবি। দ্বীপের উঁচু ঘরবাড়িও প্রায় ধসে পড়েছিল। হাওয়ার গতি এতটাই বেশি ছিল যে, তা ক্ষেতের ফসলকে ঝলসে দিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল।