অন্যরাজ্য থেকে ৩১৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠাচ্ছে কেন্দ্র

অন্যরাজ্য থেকে ৩১৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠাচ্ছে কেন্দ্র

ঞ্চায়েত ভোটের নিরাপত্তার জন্য কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে কেন্দ্রের কাছে মোট ৮২২ কোম্পানি বাহিনী চেয়ে চিঠি দিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তার পর ২২ কোম্পানি বাহিনী রাজ্যে পাঠিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। পরে আরও ৩১৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে অমিত শাহের মন্ত্রক। কিন্তু রাজ্যের চাহিদা অনুযায়ী হিসাব করলে তার পরও ৪৮৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর কথা কেন্দ্রের।

ভোটের বাকি আর ১১ দিন। রাজ্য নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রকে সে ব্যাপারে অনুরোধ করলেও কেন্দ্র এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। এর ফলে রাজনৈতিক শিবিরে জল্পনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে এবার কি হাই কোর্টের নির্দেশ পালন করতে পঞ্চায়েত ভোটের দফা বৃদ্ধি করতে হবে?

এর মধ্যে ভোট ঘিরে অশান্তি থেমে নেই। মঙ্গলবারও প্রাণহানি হয়েছে। সকালে গীতালদহের জারি ধরলা এলাকায় স্থানীয় দু'টি গোষ্ঠীর মধ্যে গুলি চালানোর খবর আসে। পুলিশ জানিয়েছে, মোট পাঁচ জন জন গুলিবিদ্ধ হন। যার মধ্যে বাবু হক নামে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূলের দাবি, বাবু তাঁদেরই কর্মী। এ ছাড়াও দিনভর রাজ্যের নানা জায়গায় অশান্তির খবর পাওয়া গিয়েছে।

আগামী ৮ জুলাই রাজ্যে এক দফায় পঞ্চায়েত ভোট। কিন্তু মনোনয়ন পর্বেই রাজ্যের নানা জায়গায় অশান্তি শুরু হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশ বিরোধীদের উপর আক্রমণ ঠেকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন বিরোধীরা। এর পর পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে করানোর দাবিতে আদালতে যায় বিজেপি এবং কংগ্রেস। অশান্তির অভিযোগের মধ্যে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয় রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট করাতে হবে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে। প্রথমে কত কেন্দ্রীয় বাহিনী তা নির্দিষ্ট করে বলেনি আদালত। এর পর ২২ জেলার জন্য ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নিয়েও শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। বিজেপি কটাক্ষ করে বলে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় যে সংখ্যক পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে, সারা রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য তার চেয়ে কম কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে কমিশন। এ নিয়ে সরাসরি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহকে আক্রমণ করেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

ঘটনাক্রমে গত ১৭ জুন হাই কোর্ট নির্দেশে জানায়, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে যে সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, সেই সংখ্যক অথবা তার বেশি বাহিনী রাখতে হবে পঞ্চায়েত ভোটে। আদালতের নির্দেশে সন্তোষ প্রকাশ করে বিরোধীরা। এর পর আবার কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে বাহিনী চায় কমিশন। কিন্তু ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে রাজ্যে। কিন্তু এখনও নির্দেশমাফিক কোম্পানি বাহিনী পৌঁছয়নি। এই প্রেক্ষিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশন চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রকে। তাতে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত বাহিনী পাঠাতে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তার জবাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কমিশন সূত্রে খবর, জবাবি চিঠিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দফতর নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে, ৩১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী খুব শীঘ্রই পাঠানো হবে পঞ্চায়েত ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু ৪৮৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে চিঠিতে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি শাহি মন্ত্রক। প্রশ্ন উঠছে সেই অভাব মিটবে কী ভাবে। এবং তা যদি না হয়, তখন শুভেন্দু অধিকারীদের অবস্থান কী হবে? ভোটের ১১ দিন আগেও এর উত্তর মিলছে না।

গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল (এএসজি) অশোককুমার চক্রবর্তী আদালতকে জানিয়েছিলেন, কমিশনের আবেদন মতো দু'দফায় ইতিমধ্যে ৩৩৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তবে বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মডেল অনুসরণ করলে সুবিধা হয়। এর পর মঙ্গলবার কমিশনকে লেখা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠিতে বাকি ৪৮৫ কোম্পানির উল্লেখ না থাকায় জল্পনা শুরু হয়েছে ২০১৩ সালের মডেল নিয়ে। রাজ্য যেখানে এক দফায় ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে চাইছে, সেখানে কেন্দ্রের এই অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা বাড়ছে।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে হিংসা

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে লাগামছাড়া হিংসার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন জমা দিলেও তা ভয় দেখিয়ে প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রক্ত ঝরেছে নির্বাচনের সময়। রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর দাবি তোলেন বিরোধীরা।

মনোনয়ন পর্বেই হিংসা শুরু

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব থেকেই অশান্তি শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ, বোমাবাজি, গোলাগুলিতে হতাহত হয়েছেন শাসক-বিরোধী দুই পক্ষেরই লোকজন। মঙ্গলবারই এক তৃণমূল কর্মীর মৃত্যু হয়েছে দিনহাটায়। গীতালদহ ২ এলাকার তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি আনারুল হকের দাবি, ''বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভোরবেলা এলাকায় ঢুকে আমাদের প্রায় ছয় কর্মীর উপর হামলা চালায়। গুলি চালানো হয় কর্মীদের লক্ষ্য করে। গুলি চালানোর পাশাপাশি, এক জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছে।'' দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেন, ''ও পার থেকে দুষ্কৃতীদের নিয়ে এসে এই ঘটনা ঘটিয়েছে বিজেপি। বিজেপির কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী বিভিন্ন রাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে দুষ্কৃতীদের এনে রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। জারি ধরলা এমন এলাকা যেখানে বিএসএফের নজর ছাড়া কিছু হওয়া সম্ভব নয়। তার পরেও এই ধরনের আক্রমণ হল। বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে কাছে এ রকম ঘটনা ঘটল। বিএসএফ কী করছিল?'' অন্য দিকে, বিজেপি তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নস্যাত্‍ করে দিয়েছে। ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ।

কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হুঁশিয়ারি

বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এখন গরু পাচার মামলায় জেলবন্দি। অনুব্রতহীন বীরভুমে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গেল তৃণমূল নেতা কাজল শেখকে। তাঁর মতে, কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটের পর চলে যাবে। কিন্তু তৃণমূল থাকবে। তিনি বলেন, ''তৃণমূলের দলীয় প্রার্থীদের হারানোর জন্য তৃণমূলেরই কিছু লোক ঢুকে আছে। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র করে নিজের দলের প্রার্থীদের হারানোর চেষ্টা করছে। আমরা তাদের সমস্ত গতিবিধি নজর রাখছি। তাদের সাবধান হয়ে যেতে বলছি।'' তাঁর সংযোজন, ''কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে। ভোট করে চলে যাবে। পরে হিসাব বুঝে নেব আমরা।'' কাজলের মন্তব্যে উস্কানি দেখছেন বিরোধীরা। তৃণমূল অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, কাজল নিজের দল নিয়ে কথা বলেছেন। কাউকে ভয় দেখাতে কিছু বলেননি।