সাবান-স্যানিটাইজার বার বার ব্যবহার করতে হচ্ছে, কী করবেন?

সাবান-স্যানিটাইজার বার বার ব্যবহার করতে হচ্ছে, কী করবেন?

করোনা আবহে শুধু মাস্ক পরলেই কিন্তু হবে না, ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বার বার হাত ধুতে হবে। সাবান জল দিয়ে হাত ধুতে হবে। সেটা সব সময় সম্ভব না হলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।

কিন্তু বার বার সাবান জলে হাত ধুলে কিংবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করলেও মুশকিল হচ্ছে। ত্বকের নানা অসুখ নিয়ে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেকেই। ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ  আবার ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই ভারসাম্য মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎকরা।

বার বার সাবান জলে হাত ধোওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। তিনি বলেন, ''বাজার-চলতি অনেক স্যানিটাইজারেই গুণমানের সমস্যা রয়েছে, সাধারণত ৬৫-৭০ শতাংশ অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে সেটি ভাইরাসনাশক হতে পারে। তবে এতে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল দিচ্ছে। তা থেকেও নানা রকম রোগ হচ্ছে। মূলত চুলকানি ও ত্বক শুকনো হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিচ্ছে বাচ্চা থেকে বুড়ো, সকলেরই মধ্যে।'

জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীও বলেন, ''কারও ক্ষেত্রে বার বার সাবানে হাত ধোওয়ার ফলে হাতে ঘা হয়ে গিয়েছে।'' দুই চিকিৎসকই মূলত সাবান জলের উপরে ভরসা করতে বলেছেন। সুবর্ণবাবু বলেন, ''স্নানের যে সাবান, গুণমান ভাল, সেই সাবান দিয়ে হাত ধুলে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কম। কিন্তু ডিটারজেন্ট বা কাপড় কাচার সাবান দিয়ে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনেকেই হয়তো হাত ধুচ্ছেন, সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে উঠছে তখনই।'' ডার্মাটোলজিস্টদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শই দিচ্ছেন তাঁরা। তবে মূলত সাবান ব্যবহারেরই পরামর্শ দিচ্ছেন দু'জনেই। যেখানে সাবান দিয়ে হাত বার বার ধোওয়ার সুবিধা নেই, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে এই ত্বকের সমস্যা খানিকটা হলেও দূর হবে, জানান সুবর্ণবাবু।

একে বর্ষার আবহ। তার মধ্যে বার বার হাত ধোওয়া, স্যানিটাইজারের ব্যবহার বাড়িয়ে দিচ্ছে ত্বকের নানা রোগ। বার বার হাত পরিষ্কার করতেও হবে। কিন্তু রোগ যাতে না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে, এমনই মত ডার্মাটোলজিস্ট অরিত্র সরকারের। তবে শুধু সাবান জলে হাত ধোওয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহারেই নয়, গ্লাভসের ব্যবহারের থেকেও ত্বকের নানা রকম রোগ হচ্ছে।

কী ধরনের সমস্যা

• হাত শুকিয়ে যাচ্ছে বা খসখস করছে

• হাতে চুলকানি

• চামড়া উঠে যাচ্ছে

• চামড়া লাল হয়ে গুটি গুটি লাল রঙের র‌্যাশ বেরচ্ছে

কেন এমন

হাতের ত্বকে যে কেরাটিনোসাইট রয়েছে, তাতে লিপিডের স্তর থাকে। যে কোনও সাবান বা অ্যালকোহলে বার বার হাত ধুলে লিপিডের স্তরটা চলে যেতে পারে, বিশেষ করে কড়া ডিটারজেন্ট হাতে লাগলে হাত শুকিয়ে যায়। ফলে ত্বকের যে আসল কাজ অর্থাৎ সুরক্ষা বা বেরিয়ার ফাংশন, তাতে ব্যাঘাত ঘটে। অ্যালকোহল-যুক্ত স্যানিটাইজার হাতের স্বাভাবিক তৈলাক্ত ভাব ধ্বংস করে দেয় বলে ত্বক শুকিয়ে গিয়ে সমস্যা হয়।

মূলত যে যে সমস্যাগুলো নিয়ে রোগীরা আসছেন, সেগুলি হল

•  ইরিট্যান্ট কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস (মূলত নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে হয়, যে কারও হতে পারে) অর্থাৎ প্রদাহ তৈরি হয়। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা সাধারণ মানুষেরও এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।

•  অ্যালার্জিক কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস (যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে)।

•  সোরিয়াসিস বা টপিক ডার্মাটাইটিস রোগীদেরও সমস্যা বাড়ছে, কারণ ত্বক আরও শুকনো হয়ে যাচ্ছে বার বার সাবান ব্যবহারের ফলে

•  নখকুনি সংক্রান্ত সমস্যা বা ক্যানডিডিয়াসিস।

•  বয়স্ক মানুষ কিংবা ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অ্যাকিউট বা ক্রনিক প্যারোনাইশিয়া। এ ক্ষেত্রে হাতে ঘা হয়, শুকাতে চায় না। বার বার হাত ধোওয়ার ফলে সমস্যা আরও বাড়ছে, ফোসকাও পড়ছে।

•  বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস। র‌্যাশ ও চুলকানির সমস্যা দেখা দেয় অনেক সময়।

কী করতে হবে

•  সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার পর ভাল কোনও ময়েশ্চারাইজার (মেডিকেটেড) ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন অরিত্রবাবু। তবে খাবার খাওয়ার আগে কখনওই নয়।

•  সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হাত মুছে নিতে হবে পরিষ্কার কোনও কাপড়ে। ময়েশ্চারাইজার না থাকলে পেট্রলিয়াম জেলি বা তরল প্যারাফিন বেসড বা নরম প্যারাফিন বেসড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।

•  সুতির গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।

•  ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করাও তৃতীয় বিশ্বের দেশে হয়তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে নারকেল তেল ব্যবহার করা যেতে পারে, জানিয়েছেন এই চিকিৎসক।

•  ডায়াবিটিস রয়েছে, নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে কাজে যেতে হচ্ছে, হাতের ব্যবহার বেশি হয় এমন কাজ করতে হয়, বাইরে বেরতে হচ্ছে, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল গ্লাভস বা রবার গ্লাভস সংক্রমণ-আতঙ্কে ব্যবহার করলে তার ভিতরে সুতির গ্লাভস পরতে পারলে ভাল।

•  এগজ়িমা সংক্রান্ত চুলকানি বেশির ভাগ সময়েই নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। হাতে নখ ছোট করে কাটা থাকলে সংক্রমণের ভয় কমবে।

•  ত্বকের যে কোনও সমস্যায় কী ওষুধ খেতে হবে বা কোন মলম দিতে হবে, তা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না, জানান অরিত্রবাবু।

নিরাময়ের উপায়

ইন্টারট্রিগো ক্যানডিডিয়াসিস প্যারোনাইশিয়া (চলতি ভাষায় নখকুনি)-র ক্ষেত্রে ক্লট্রিমাজল মাইকোনাজল রয়েছে এ জাতীয় ক্রিম, কোনও ক্ষেত্রে ফ্লুকোনাজল ট্যাবলেট দেওয়া হয়। 

ডার্মাটাইটিসে মিড পোটেন্ট স্টেরয়েড ক্রিম ও ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে অ্যান্টিহিস্টামিনিক দেওয়া হয়।

ডার্মাটাইটিসে ‘সেকেন্ডারি ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন’-এর ক্ষেত্রে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।

অ্যালার্জিক কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস সমস্যা বেশি হলে অল্প সময়ের জন্য স্টেরয়েড খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বার বার সাবান ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের ফলে হাতের ত্বকে র‌্যাশ, ছাল উঠে যাওয়া-সহ নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সকলের না হলেও অনেকেই এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু হাত তো কোনও মতেই এড়ানো যাবে না। তাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নারকেল তেল, ক্রিম বা ময়েশ্চারাইজার লাগালে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না। ভাল থাকুন। কোনও সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।