স্বামী-সন্তানকে হত্যা করাই ছিল তার নেশা

স্বামী-সন্তানকে হত্যা করাই ছিল তার নেশা

মানুষের চেহারার আড়ালে পশুর সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেখতে আপদমস্তক মানুষ হলেও মনে তারা ধারন করেছিলেন হিংস্রতা। মমতা বলতে তাদের মনে কিছুই ছিল না। হত্যা করতে যাদের একটুও হাত কাঁপত না। বাইরের মানুষ তো আছেই পরিবারের মানুষদেরও হত্যা করেছেন বিকারগ্রস্তরা।

প্রতি শতাব্দীতেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এমন অনেক সিরিয়াল কিলার। মানুষ হত্যা করা যাদের ছিল এক প্রকার নেশা। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও কম নয়। ইতিহাসে লেডি ব্লুবার্ড খ্যাত বেলে গুনেস হত্যা করতেন নিজের স্বামী ও সন্তানদের। একের পর এক বিয়ে করা ছিল তার নেশা। এরপর স্বামী এবং সন্তান সবাইকে হত্যা করে আবার নতুন সংসার শুরু করতেন। মোট ১৫ জন স্বামী এবং সন্তানসহ ৪২ জনকে হত্যা করেছিলেন বেলে।

১৮৫৯ সালের ১১ নভেম্বর নরওয়েতে বেলে গুনেসের জন্ম। বেলের পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র্য। তবে ভাগ্য ফেরাতে ২৩ বছর বয়সে বেলে চলে আসেন আমেরিকাতে। এখানে এসে তার পরিচয় হয় ম্যাড সোরসান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। এরপর তাদের প্রেম ও পরিণয়। ১৮৯৩ সালে তারা বিয়ে করেন। বেলে তার স্বামীর সঙ্গে মিলে একটি কনফেকশনারি দোকান চালাতেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের চার ছেলেমেয়ের জন্ম হয়। ক্যারোলিন, এক্সেল, মার্টল আর লুসি নাভে ও জেনি নামের একটি মেয়েকে তারা দত্তকও নিয়েছিলেন। মোট ৫ সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল বেলের সংসার।

হঠাত্‍ করেই বেলের দুই ছেলে মেয়ে মারা যান। পেটের ব্যথ্যায় তাদের মৃত্যু হয় বলে সবাই জানত। এর কিছুদিন পর তাদের কনফেকশনারি দোকানে আগুন লেগে পুড়ে যায় সবকিছু। দিশেহারা অবস্থা বেলের। বেলে আর তার স্বামী দোকানের যে বীমা করা ছিল সেই টাকা পায় কয়েকদিনের মধ্যে। এছাড়াও যে দুই সন্তান মারা গেছে তাদের জীবন বীমার টাকাও পান তারা।

তবে রহস্যজনকভাবে যেদিন তারা টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলো সেদিনই বেলের স্বামী ম্যাড সোরসান মারা যান। সবকিছুই আশেপাশের মানুষের কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। বেলের পরিবারের উপর এত ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে অথচ বেলের চোখে মুখে কেমন যেন তৃপ্তির হাসি।

ম্যাড সোরসানের পোস্টমর্টেম দেখে চিকিত্‍সকরা সন্দেহ করতে থাকেন বেলেকে। কারণ তার শরীরে এক ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যেই রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল বেলের মারা যাওয়া দুই সন্তানের শরীরেও। যদিও বেলে এগুলোর কিছুই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। বারবার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাককে দায়ী করেছিলেন তিনি। পুলিশ স্বামী-সন্তানের হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করে বেলেকে।

আসলে এটিই ছিল বেলের শুরু। নিজের সন্তানকে দিয়েই মানুষ হত্যার বনি করেছিলেন তিনি। যদিও এই হত্যার সঙ্গে তার স্বামীও জড়িত ছিলেন। মূলত জীবন বীমার টাকা পেতেই তারা সন্তানদের হত্যা করেন। একই কারণে নিজেদের দোকানও পুড়িয়ে দেয়। টাকা পাওয়ার পর নিজের স্বামীকেও হত্যা করেন বেলে। অত্যন্ত বিষাক্ত, বর্ণহীন এই বিষ দিয়েই স্বামী এবং সন্তানদের হত্যা করেছিলেন তিনি।

পুলিশের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় কিছুদিন পরই বেলে ছাড়া পেয়ে যায়। বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে চলে যান ইন্ডিয়ানাতে। সেখানে ৪২ একরের একটা ফার্ম কিনে নেন। তবে এই ফার্ম তিনি সুখে শান্তিতে সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন কাটানোর জন্য কিনেননি। বরং এই ফার্মই পরে পরিচিতি পেয়েছিলো দ্য ডেথ গার্ডেন হিসেবে। এই বাগান বাড়িতেই তিনি তার বেশিরভাগ খুনগুলো করেছিলেন।

এই ফার্ম কেনার কয়েকদিন পরই ফার্মের একাংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। একইভাবে বীমার টাকা আদায় করেন। এখানে এসে পিটার গুনেস নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন ১৯০২ সালের পহেলা এপ্রিল। পিটারের এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে তার দুই মেয়েও আছে। তাদের নিয়ে বেলের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন।

কিছুদিন পরই ছোট মেয়েটির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পিটার কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন যে কিছু একটা গড়বড় আছে। তখন তিনি তার বড় মেয়ে সোয়ানহিল্ডকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। এটি ছিল তার সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ শুধু এই মেয়েটিই বেলের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন তিনি।

পিটার মারা যান পরের বছরই। অর্থাত্‍ ১৯০৩ সালে। বলা হয় রান্নাঘরের জাঁতাকল মাথায় পড়ে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু পিটারের বড় মেয়ে জেনি খুনটা দেখে ফেলেছিল তার বাবার মৃত্যুর আসল কারণ। এ কথা সে তার এক বান্ধবীকেও বলে, যে তার মা-ই তার বাবাকে জাঁতাকল দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

পোস্ট মর্টেমের সময় আবারো মৃতের শরীরে স্ট্রিকনাইনের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, প্রথমে বিষ প্রয়োগ করে পরে দুর্ঘটনার ঘটনা সাজানো হয়েছিল। কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যও বিষ প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পর বেলের আহাজারি দেখে কেউই তাকে খুনি ভাবতে পারেনি।

পিটারের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই বেলে তার জীবন বীমার টাকা তুলে ফেলেন। এর ৬ মাস পরই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন বেলে। তার নাম রাখেন ফিলিপ গেনেস। এরপর থেকে শুরু করেন নতুন এক উপায়। খুন করা যে নেশা হয়ে গিয়েছিল তার। একদিকে টাকার লোভ অন্যদিকে খুনের নেশা। তবে বেলে আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি।

এবার পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেন। বিজ্ঞাপনে শর্ত থাকতো, বিয়েতে আগ্রহী পুরুষকে অবশ্যই তার সেভিংস এর টাকা নগদ নিয়ে কনে দেখতে কনের বাড়িতে আসতে হবে। সুন্দরী বেলের সেই প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছেন অনেকে। এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেক পুরুষই টাকা নিয়ে বেলের ফার্ম হাউসে যেতেন। কিন্তু আর কখনো ফিরে আসতেন না।

বেলে দেখতে যেমন সুন্দরী ছিলেন, তেমনি ছিলেন খুবই স্বাস্থ্যবান। খুব সহজেই যে কোনো পুরুষকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতেন তিনি। জন মু, হেনরি গারহোল্ট, ওলফ সেভেনহার্ড, ওল বি বাডসবার্গ, ওলাফ লাইন্ডব্লুম, আন্দ্রে হেগেলিন নামের ব্যক্তিদের হত্যা করেছেন তিনি। এই তালিকায় আরও অনেক মানুষই আছেন, যারা খুন হয়েছেন বেলের হাতে। তবে তাদের সঠিক পরিচয় ও সংখ্যা জানা যায়নি।

সময়টা ১৯০৮ সাল। বেলের এই রহস্য ফাঁস হয় আন্দ্রে হেগেলিনকে হত্যার পর। আন্দ্রে হেগেলিন নিখোঁজ হওয়ার পর তার ভাই তার খোঁজ নিতে শুরু করেন। আন্দ্রে হেগেলিনেরর অন্তর্ধান নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এদিকে বেলের ফার্মহাউজ আগুনে পুড়ে ছাই। উদ্ধারকারীরা বেলের তিন সন্তানের পুড়ে যাওয়া লাশ পেলেন। পাশেই পড়েছিল আরেকটি মাথাবিহীন লাশ। তবে সেটা বেলের লাশ ছিল না। কারণ বেলে ছিলেন দীর্ঘদেহী, অন্যদিকে গলাকাটা লাশটা ছিল ক্ষীণ দেহের। তাহলে বেলে কোথায়?

উদ্ধারকর্মীরা লাশের মাথার খোঁজ শুরু করলেন বাগানবাড়ির আশেপাশে। বাগানের মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসতে শুরু করলো একের পর এক কঙ্কাল। শুধু সেই বাগানবাড়ি থেকেই ১২ জনের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়, যারা পুলিশের খাতায় এতদিন নিখোঁজ ছিলেন। কঙ্কালগুলোর মধ্যে কিছু শিশুর কঙ্কালও ছিল। তবে সেই কাটা মাথাটি পাওয়া যায়নি কোথাও। সেই সঙ্গে বেলেও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

এদিকে বেলের ফার্মহাউজে আগুন দেওয়ার অপরাধে রে ল্যাম্ফার নামের এক প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রে ল্যাম্ফার শুধু আগুন দেওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। তবে দাবি করেন খুনের ঘটনা তিনি কিছুই জানতেন না। জেলেই মারা যায় রে ল্যাম্ফার। তবে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে রে ল্যাম্ফার স্বীকার করেন। পুরোটাই ছিলো বেলের পরিকল্পনা। মুন্ডুহীন লাশ রেখে তিনি আসলে নিজের মিথ্যা মৃত্যু সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃতদেহের সঙ্গে তার দৈত্যাকার দেহের কোনো মিল ছিল না।

এদিকে ফার্মহাউজে আগুন লাগার কিছুদিন আগেই বেলি তার বেশিরভাগই টাকা পয়সা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছিলেন। তবে বেলের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি কোনোদিন। তিনি কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। তবে ১৯৩১ সালে এস্টার কার্লসন নামের এক নারী লস অ্যাঞ্জেলসে বিচারাধীন অবস্থায় মারা যায়। তার বিরুদ্ধে এক লোককে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগ ছিল।

কার্লসনের চেহারা এবং শারীরিক গঠনের সঙ্গে বেলে গেনেসের অনেক মিল পাওয়া যায়। তারা প্রায় একই বয়সের ছিলেন। আবার কার্লসনের একটা ছবি পাওয়া যায় তার তিনটা সন্তানের সঙ্গে। সেখানে তাকে দেখতে বেলের মতোই লাগছিল। তবে এখনকার মতো তখন প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। যে কারণে বেলে পালিয়ে বেঁচেছিল। এরপর আরও কত মানুষের প্রাণ নিয়েছেন সেই ইতিহাস কেউই জানতে পারেনি।

আসলে বেলে ছোট থেকে দরিদ্র্য পরিবারে বড় হয়েছে। যে কারণে অভাবেই দিন কাটত তাদের। টাকার জন্য বিভিন্ন কাজ করতেন তিনি। বেলে ১৯ বছর বয়সে গর্ভবতী হয়ে ছিলেন। তখন তিনি নরওয়েতেই ছিলেন। গর্ভবতী অবস্থায় বারে নাচতে গিয়েছিলেন কিছু টাকার জন্য। সেখানে একজন বড়লোকের ছেলে তার পেটে লাথি মারেন এবং এতে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরেই ঐ লোকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।

সেসময় থেকেই বেলের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে আমেরিকায় এসে তিনি পরিণত হন ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত এবং নিষ্ঠুর সিরিয়াল কিলারে। এমটাই দেখানো হয়েছিল একটি আইরিশ টিভি ডকুমেন্টারিতে। তবে এর সত্যতা নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদের দ্বিমত আছে।

২০০৭ সালে ইন্ডিয়ানাপলিস বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র মুণ্ডুহীন সেই মৃতদেহটি পরীক্ষা করেছিল। তবে বেলের ডিএনএ-এর কোনো স্যাম্পল না থাকায় সেটি বেলের মৃতদেহ ছিল কিনা তা প্রমাণ করা যায়নি। সেদিনের পর আসলেই বেলে বেঁচে ছিলেন কি না বা তার কোনো সন্তান ছিল কি না তা কিছুই জানা যায়নি। তবে যে এলাকায় বেলের ফার্ম ছিল ওই সময়টাতে ওই এলাকার ২১টি শিশু নিখোঁজ হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের আর কোনো খোঁজও মেলেনি।