চাকরি দেওয়ার নামে কেলেঙ্কারি খোদ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়ো নিয়োগপত্র বিলি করার অভিযোগ

চাকরি দেওয়ার নামে কেলেঙ্কারি খোদ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়ো নিয়োগপত্র বিলি করার অভিযোগ

 চাকরির পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। পূজার মধ্যেই হাজার হাজার চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কখনও নেতাজি ইন্ডোরে, কখনও বা মেদিনীপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার দাবি করেন।

তিনি কথা রেখেছেন। বেশ কয়েক হাজার যুবক যুবতীকে তুলে দিয়েছেন নিয়োগপত্র। কিন্তু জানেন কি সেই নিয়োগপত্রের মূল্য কতটা?

আসুন দেখে নেওয়া যাক এক চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়া যুবকের অভিভাবকের সঙ্গে ওই নিয়োগপত্রে উল্লেখিত ফানফার্স্ট কোম্পানির এক আধিকারিকের ফোনে কথপোকথন। সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি সেই সংস্থার আধিকারিকের সঙ্গে কথপোকথনের কথা তুলে ধরেছে। আমাদের পক্ষ থেকে সেই কথপোকথনের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। জানা গিয়েছে, ফানফার্স্ট কোম্পানির সেই আধিকারিকরের নাম বেদপ্রকাশ সিং। আমরা চেষ্টা করেছি সেই কথপোকথন হুবহু তুলে ধরার। তবে

অভিভাবক: বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে অফার লেটার পেয়েছি। চিঠিতে আপনার মোবাইল নাম্বার দেওয়া আছে। ১৪ সেপ্টেম্বর আমাদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ১৩ তারিখ চিঠিটা হাতে পেয়েছি। আপনি কি গুজরাট থেকে বলছেন?

বেদপ্রকাশ সিং: এটা কি আপনার বাচ্চার জন্য? না অন্য কেউ?

অভিভাবক: হাঁ, আমার বাচ্চার জন্যই।

বেদপ্রকাশ সিং: উনি কী নিয়ে পড়াশোনা করেছেন?

অভিভাবক: ভোকেশনাল করেছে, কম্পিউটার নিয়ে।

বেদপ্রকাশ সিং: দেখুন আমি আপনাকে একটা কথা পরিস্কার করে বলতে চাই। আপনি যে অফার লেটারের কথা বলছেন, সেটা ভুয়ো। ঠিক আছে। আবার বলছি, এটা ভুয়ো। তবে আমি ফানফার্স্ট কোম্পানি থেকেই বলছি। এটা সত্যি। গুজরাটে সুজুকি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের আইটিআই নিয়ে প্রশিক্ষণের কর্মসূচি চলে। এটাও ঠিক। গুজরাটে যারা আসে তাদের কাছে এই অফার লেটারই যায়। আমার নামেই যায়। আমার নাম্বারই দেওয়া থাকে। কারণ, আমি এখানকার সেন্টার ম্যানেজার। সবটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের অফার লেটারকে নিপুণভাবে 'গলত তরিকা সে' ব্যবহার করা হয়েছে।

ওই অফার লেটারে যা আছে তাতে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। সেই ছেলেরা ইতিমধ্যে এসেও গেছে। এখন বাংলা থেকে আমার কাছে সকাল থেকে শুধু ফোনই আসছে।

অভিভাবক: সে তো আসবেই।

বেদপ্রকাশ সিং: আমাদের কোম্পানি ফানফার্স্ট স্কিলার প্রাইভেট লিমিটেড। বহুদিন ধরে স্কিল ডেভেলপমেন্টের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের হেড অফিস মুম্বাই। আমেদাবাদ থেকে ১১০ কিমি দূরে মারুতি সুজুকি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের আইটিআই ছেলেদের নিয়ে দু'বছর ধরে কাজ চলছে। আপনি কি আমায় কোন নাম্বার থেকে এই চিঠি পেয়েছেন তা দিতে পারবেন?

অভিভাবক: আমি স্ক্রিনশট তুলে আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বেদপ্রকাশ সিং: কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও ছেলেকে কাজ দেওয়ার কথাই নেই। আমাদের অফার লেটার নিয়ে ভুয়ো করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

এই কথোপথনের পরেই ফোন নামিয়ে রাখেন অভিভাবক। একজন মাত্র অভিভাবকই নয়, অফার লেটার হাতে পাওয়া শ'খানেক ছাত্রের অভিজ্ঞতা এমনই। ভুয়ো অফার লেটার তুলে দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আর কেউ নয়, খোদ রাজ্য সরকারই।

রাত জেগে বিলি করা হলো চাকরির নিয়োগ পত্র। হুগলির নোডাল অফিসে গত মঙ্গলবার এসে পৌছায় তিন হাজারের বেশি চাকরি প্রার্থীর নিয়োগপত্র। উত্‍কর্ষ বাংলা প্রকল্পের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা বিভাগ থেকে তরুণ তরুণীদের প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ শেষে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। গত ১২ সেপ্টেম্বর নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাসে করে বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাদের অফার লেটার তুলে দেবেন এমনই বলা হয়।

এর মধ্যে হুগলি জেলার ১০৭ জনকে পরে ফোন করে জানানো হয় হুগলি এইচআইটি কলেজ থেকে অফার লেটার সংগ্রহ করে নিতে। প্রত্যেকের মোবাইলে একটি পিডিএফ ফাইল দিয়ে দেওয়া হয় গত মঙ্গলবার। হুগলি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি কলেজে অফার লেটার নিতে আসে অনেকেই। চিঠিতে লেখা গুজরাটের মারুতি সুজুকি কোম্পানিতে দুই বছরের আইটিআই প্রোগ্রামে ভেহিকেল টেকনিক্যালের ট্রেনিং দেওয়া হবে। এগারো হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। সেন্টার ফি বহন করবে সুজুকি মোটরস গুজরাট প্রাইভেট লিমিটেড। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নথি দেখার পরই প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হবে। চিঠির নিচে সেন্টার ম্যানেজার হিসাবে বেদপ্রকাশ সিংয়ের নাম ও ফোন নম্বরও দেওয়া হয়।

সেই নম্বরে ফোন করে প্রার্থীরা জানতে পারে এই প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাই ভূয়ো। যেভাবে তাদের চিঠি ধরানো হয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য এটা কোনও পদ্ধতিই নয়। তারা গুজরাটে প্রশিক্ষণ দেন, তার জন্য যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয় এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে চিঠি কোম্পানির প্যাডে ইস্যু করা হয়। ফানফার্স্ট নামে এক সংস্থার সঙ্গে সুজুকি যৌথভাবে প্রশিক্ষণ দেয় জানান বেদপ্রকাশ। ফানফার্স্টের পক্ষ থেকে সিদ্ধার্থ শংকর জানান, গতকাল রাতেই বিষয়টি তারা জানতে পারেন। এই ধরনের কোনও চিঠি তারা ইস্যু করেননি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকদের মেল করে জানানো হয়েছে। তাদের সংস্থা বিহার উত্তর প্রদেশের ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কেউ এখনো নেয়নি।