অভিষেককে ফেরানোর মাশুল গুণছেন শান্তনু, হাতছাড়া মতুয়াগড়

অভিষেককে ফেরানোর মাশুল গুণছেন শান্তনু, হাতছাড়া মতুয়াগড়

উনিশের ভোটে মতুয়ারা দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির বড় ছেলের পাশে। একুশের ভোটেও তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পাশে। কিন্তু তেইশের ভোটে আর তাঁরা রইলেন না পাশে। চলে গেলেন তাঁরা মুখ ফিরিয়ে ঘাসফুলের গড়ে। ঠাকুরবাড়ির ছেলে রইলেন হাতেগোনা কিছু অনুগামীদের নিয়ে। নজরে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনা(North 24 Pargana) জেলার বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর(Shantanu Thakur)।

যে মতুয়াদের(Matuya) ভোটে তিনি সাংসদ হয়েছেন, কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন, সেই মতুয়ারাই এবার তাঁকে চরম শিক্ষা দিয়ে ছাড়ল। বুঝিয়ে দিল মন্দির কারও একার নয়। বুঝিয়ে দিল ২৪'র ভোটে এবার তাঁকেও বিদায় নিতে হবে।

উনিশের ভোটে বাংলার বুকে বিজেপির উত্থানের নেপথ্যে একটা বড় ভূমিকা ছিল মতুয়া ভোটের। নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে মতুয়ারা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছেন। বিজেপি থেকে সেই দাবি সমর্থন করা হয়। তার জেরেই উনিশের ভোটে মতুয়ারা দুই হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছিল বিজেপিকে। সেই ভোটে বনগাঁ থেকে শুধু যে মতুয়াদের ধর্মের প্রাণকেন্দ্র উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ(Bongna) মহকুমার গাইঘাটা ব্লকের ঠাকুরনগরে ঠাকুরবাড়ির বড় শান্তনু ঠাকুর জিতে সাংসদ হন তাই নয়, নদিয়া জেলার রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র থেকেও জয়ী হয়েছিলেন বিজেপির অপর প্রার্থী জগন্নাথ সরকার। কিন্তু সেই নির্বাচনের পরে প্রথম ৩ বছরেও মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদান করেনি কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির সরকার। কার্যত সেই পথে হাঁটতে গেলে যে সব আইন প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল, সেই সব করে উঠতেই পারেনি বিজেপি(BJP) পরিচালিত কেন্দ্রের সরকার। আর তার জেরে তৃণমূলের দাবি ছিল, বিজেপি কার্যত মতুয়াদের ভুয়ো আশ্বাস দিয়ে ভোটের রাজনীতি করছে।

একুশের ভোটেও নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন অমিত শাহ। তার জেরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার ৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে এবং নদিয়া জেলার রানাঘাট ও কল্যানী মহকুমার ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ের মুখ দেখেছিল বিজেপি। কিন্তু তারপরেও মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে এক পাও এগোয়নি মোদি সরকার। আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সময় যতই গড়িয়েছে ততই মতুয়াদের বিজেপির থেকে মুখ ঘোরানোর ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে। এই ক্ষোভে কার্যত ঘৃতাহুতি দেন শান্তনু ঠাকুর নিজে। নবজোয়ার কর্মসূচীতে ঠাকুরনগরে এসেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়(Abhishek Banerjee)। সেদিন তাঁকে ঠাকুরবাড়ির মূল মন্দিরে ঢুকতে দেননি শান্তনু। নিজে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে নিয়ে সেই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার জেরে অভিষেক সেই মন্দিরে ঢুকতে না পেরে পাশের মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরে যান। এই ঘটনা ধর্মপ্রাণ মতুয়ারা মেনে নিতে পারেননি। কার্যত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে সেই ঘটনা গোটা মতুয়া গড়ে বিজেপিকে যতটা ড্যামেজ করে দেয় তা মেরামতের সুযোগ পাননি গেরুয়া শিবিরের নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, কার্যত মতুয়া গুরুরা বলেও দিয়েছিলেন, মন্দির কারও পারিবারিক সম্পত্তি নয়। কাউকে মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়া পাপ। তার ফল গুণতে হবে। হয়েওছে তাই। মতুয়া গড়ে ধসেছে বিজেপির দুর্গ।

পরিসংখ্যান বলছে, বনগাঁ মহকুমার ৩টি পঞ্চায়েত সমিতিই গিয়েছে তৃণমূলের(TMC) দখলে। ওই এলাকার ৯টি জেলা পরিষদ আসনও গিয়েছে তৃণমূলের দখলে। কার্যত উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে খাতাই খুলতে পারেনি বিজেপি। বাগদা, বনগাঁ ও গাইঘাটা - মতুয়া প্রভাবিত এই ৩ ব্লকের ৩৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩৫টিতেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩টি পঞ্চায়েত। বনগাঁ ব্লকে মোট ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। সবকটিতেই তৃণমূল জয়ী হয়েছে। বাগদার ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টিতে তৃণমূল জিতলেও ৩টিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি। গাইঘাটার ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১২টিতেই তৃণমূল জয়ী হয়েছে। মাত্র ১টি গ্রাম পঞ্চায়েত বিজেপি দখল করেছে। নদিয়া জেলার ছবিটাও একই। সেখানেও একই ছবি। গ্রামে গ্রামে দাপট তৃণমূলের। পঞ্চায়েত সমিতিও তৃণমূলের দখলে। বিজেপিকে হারতে হয়েছে মতুয়া প্রভাবিত এলাকার জেলা পরিষদের আসনেও।