বাংলায় তৃণমূল বনাম গেরুয়া মেরুকরণের কি এখানেই ইতি?

বাংলায় তৃণমূল বনাম গেরুয়া মেরুকরণের কি এখানেই ইতি?

শনিবার বাংলায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনকে (WB panchayat election) কেন্দ্র করে ফের হিংসা আর অশান্তির কোলাজ দেখল বাংলা। শুক্রবার রাত থেকে শুরু করে শনিবার সারা দিনে দফায় দফায় সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। কমবেশি আহতের সংখ্যা কয়েক'শ।

পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও হিংসা আর অশান্তির ভয়াবহ ছবি দেখা গিয়েছিল।

পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে সিপিএমের এক কর্মী ও তাঁর স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও এটা বাস্তব যে, গত পঞ্চায়েত ভোটে গোটাটাই ছিল এক তরফা। বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল 'উন্নয়ন'কে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন রাস্তায়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিলেন গোটা একটা জেলা পরিষদ। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ৩৩ শতাংশ আসনেই কোনও বিরোধী প্রার্থী ছিল না।

হিংসার ছবি এক থাকলেও শনিবারের পঞ্চায়েত ভোটকে কিন্তু আঠারো সালের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। কারণ এদিন দেখা গেল, ব্যাপারটা আর এক তরফা নেই। বরং গত ১২ বছরে এই প্রথম বেশ কিছু জেলায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে শাসকদল তৃণমূলকে। মৃত ১৫ জনের মধ্যেই বেশিরভাগই হলেন তৃণমূল কর্মী। যা জোড়াফুলের পক্ষে মোটেই স্বস্তির খবর নয়। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, কোচবিহারের একটা অংশ, নদিয়ার কিছুটা অংশ, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বর্ধমানের একাংশ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে স্থানীয় তৃণমূল মোটেই তাঁদের মতো করে ভোট করাতে পারেনি।

তবে এ যদি তৃণমূলের জন্য অশনি সংকেত হয়, তাহলে তা সমানভাবে বিজেপির জন্যও বিপদের বলেই মনে করা হচ্ছে (TMC vs BJP)। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন? তার কারণ হল, শনিবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ দিনভর দেখা গিয়েছে, তার বেশিরভাগেরই নেতৃত্বে ছিল বাম-কংগ্রেস। সবচেয়ে বেশি অশান্তির ঘটনা ঘটেছে মুর্শিদাবাদে। কারণ, সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ হয়েছে সেখানে। সেই সঙ্গে প্রতিরোধ হয়েছে মালদহ, বীরভূম, বর্ধমান জেলায়। বিজেপি নেতারা যখন দিনভর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য কান্নাকাটি করে সময় ব্যয় করেছেন, তখন দেখাই যায়নি অধীর চৌধুরী, মহম্মদ সেলিমদের। তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন ভোট করাতে। সন্ধে ৬টার পর ফের দেখা গিয়েছে দু'জনকে।

বিজেপি যে প্রতিরোধ একবারে দেখাতে পারেনি তা নয়। কোচবিহারের একাংশে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে বিজেপি। আলিপুরদুয়ার, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়াতে বিজেপি ভাল ফল করতে পারে। কিন্তু প্রতিরোধের ছবিতে অনেক বেশি মজবুত দেখিয়েছে বাম-কংগ্রেসকে।

তাত্‍পর্যপূর্ণ এদিন ভোট গ্রহণ পর্বের শেষে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বেলাগাম সন্ত্রাস চালিয়েছে। তারপরেও মানুষ ভোট দিয়েছে। সেই ভোটের গণনা ঠিকমতো হলে দেখা যাবে তৃণমূল কতটা জমি হারিয়েছে।' আবার অধীর চৌধুরী বলেছেন, 'নির্বাচন কমিশনকে চিঠি চাপাটি পাঠিয়েছি ঠিকই। কিন্তু সে বোবা কালা। মানুষ তৃণমূলের সন্ত্রাস ঠেকিয়ে দিয়েছে।' বিপরীতে বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে বলতে শোনা গিয়েছে, 'নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।' আর শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার ফের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন তিনি।

তিন দলের এই প্রতিক্রিয়াতেও একটা মৌলিক ফারাক দেখা যাচ্ছে। বাম, কংগ্রেস যখন নিজের ক্ষমতায় লড়াইয়ের কথা বলছে, তখন বিজেপি অনেক বেশি ভরসা করছে দিল্লির সরকার বা হাইকোর্টের উপর।

রাজনীতিতে ধারণাই সব। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি না হোক। তাতে গত লোকসভা ভোটের মতই এবার লোকসভা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই এবার বহু জেলায় বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা দেয়নি তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত ভোটের তুলনায় দ্বিগুণ আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে বিজেপি, বাম, কংগ্রেস। শনিবারের সামগ্রিক ছবিটা দেখলে বোঝা যাবে, এদিন হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, দুই বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দিনাজপুর-সহ বেশ কিছু জেলায় মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। অশান্তির ঘটনা সীমিত ছিল মূলত মুর্শিদাবাদ, মালদহ, কোচবিহার, পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী, নদিয়া ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার একাংশে। সেই সব অশান্তির ঘটনা তৃণমূলের ভাবমূর্তির জন্য ভাল বার্তা দেয়নি।

কিন্তু তার চেয়েও একটা বড় ছবি রাজনৈতিক ধারণায় উঠে আসছে। তা হল, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে তৃণমূল বনাম বিজেপির মেরুকরণ ঘটেছিল, তা যেন আর থাকছে না। এই মেরুকরণের সুবিধা ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পেয়েছিল বিজেপি। একুশের বিধানসভা ভোটেও পেয়েছিল। তৃণমূল-বিজেপি মেরুকরণের কারণে বাংলায় আরও প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল বাম, কংগ্রেস।

কিন্তু এবারের পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গেল, বাম-কংগ্রেস তাদের আগের জায়গা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী। তাদের লড়াইয়ে দেখা তো গেলই। মানুষের মুখে আলোচনাতেও জায়গা করে নিয়েছে তারা। এই ধারণা বিজেপির জন্য ভাল, তা কী করে বলা যায়!

মনে রাখতে হবে যে একুশের ভোটে বাংলায় বিজেপি যে ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তা কেবল হিন্দু ভোটের মেরুকরণের জন্য পায়নি। তা পেয়েছিল তৃণমূল বিরোধী ভোটের মেরুকরণের জন্য। কিন্তু সেই মেরুকরণ যদি আর না থাকে, তাতে যদি বাম-কংগ্রেস মিলিত ভাগ বসায় তাহলে বিজেপির ঝুলিতে সেই ভোট শতাংশ কি থাকবে?

এটা ঠিক যে রাজনীতি ওয়ান ডে ম্যাচ নয়। তা প্রবাহমান। তবে আজ অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে যে এই পঞ্চায়েত ভোট বিজেপিকে একটা ওয়ার্নিং দিয়ে গেল।