ইডির জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তৃণমূলের প্রচার থেকে উধাত্ত যুবনেত্রী সায়নী ঘোষ

ইডির  জিজ্ঞাসাবাদের মুখে  তৃণমূলের প্রচার থেকে উধাত্ত যুবনেত্রী সায়নী ঘোষ

ঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের প্রচারকারীদের তালিকায় দলের যুবনেত্রী সায়নী ঘোষের নাম ছিল না শনিবার। শুক্রবার ইডির ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছিলেন সায়নী। নিয়োগ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী বুধবার তাঁকে আবারও তলব করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এর পরেই জল্পনা তৈরি হয়, তবে কি সায়নীকে তৃণমূলের হয়ে ভোটপ্রচারে দেখা যাবে না?

প্রচারের যে ক'দিন বাকি আছে, তাঁকে কি আড়ালেই রাখবে দল? সায়নী নিজে যদিও শনিবার সকালে সেই জল্পনা উড়িয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দল তাঁর পাশেই আছে। দলের হয়ে প্রচারেও থাকবেন তিনি। সেই মতো সময়সূচি ঠিক করছেন।

সায়নীর 'ইতিবাচক' মন্তব্যের পর যদিও জল্পনা থামছে না। অনেকে মনে করছেন, নিয়োগ মামলায় বর্তমানে এমনিতেই খানিকটা 'কোণঠাসা' তৃণমূল। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনৈতিক ভাবে বিষয়টির মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। সায়নীকে সেই বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি প্রচারে নামলে তার ফল কী হবে, তা নিয়ে খানিক সংশয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব। সে কারণেই শনিবারের তালিকায় সায়নীর নাম রাখা হয়নি। পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে আপাতত তাঁকে আর না-ও রাখা হতে পারে। তবে সায়নীর 'হিতৈষী'দের বক্তব্য, তিনি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় 'অভিযুক্ত' নন। তিনি বলিষ্ঠ ভাবেই ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন। ফলে তিনি প্রচার করলে কোনও 'বিপরীত' ফল হবে, এমনটা নয়।

তৃণমূলের একাংশ আবার বলছে, আগামী বুধবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরা দেওয়ার আগে সায়নীকে আরও নথিপত্র জোগাড় করতে হচ্ছে। তিনি আগামী কয়েক দিন সেই কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন। তা-ই তাঁকে পঞ্চায়েতের প্রচারে আপাতত রাখা হচ্ছে না। দলের অন্য অংশ যদিও অতি সাবধানী। তাঁরা দেখতে চান রবি, সোম বা মঙ্গলবার সায়নীকে প্রচারে পাঠানো হয় কি না। তার আগে তাঁরা এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত সূচি অনুযায়ী, আগামী শনিবার ৮ জুলাই পঞ্চায়েত ভোট। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে শনিবার এক দফাতেই ভোট হবে। তার ৪৮ ঘণ্টা আগে বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার শেষ হওয়ার কথা। সেই হিসাব অনুযায়ী, প্রচারের জন্য বাকি আর পাঁচ দিন। রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ এবং বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার চলবে। প্রতি দিনই সকালে দলের তরফে প্রচারকদের তালিকা প্রকাশ করার কথা তৃণমূলের। সায়নীর নাম তৃণমূল এই পাঁচ দিন প্রচারকের তালিকায় রাখে কি না, সে দিকে নজর থাকবে।

শুক্রবার সায়নীকে টানা ১১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। সকাল ১১টা ২১ মিনিটে তিনি ইডি দফতরে ঢুকেছিলেন। যখন বেরিয়ে আসেন, রাত তখন ১০টা ৪৫ মিনিট। তখনও কিন্তু সায়নীর গলায় ছিল 'আত্মবিশ্বাসের সুর'। তিনি বলেছিলেন, ''আজ প্রাথমিক কিছু নথি নিয়ে ডেকেছিলেন। আরও কিছু নথির ডিটেল আনতে বলেছেন। আমি ১০০ শতাংশ সহযোগিতা করেছি।'' তদন্তের সুবিধার জন্য ১০০ বার আসতে হলেও তাঁর আপত্তি নেই বলে জানান যুবনেত্রী। তিনি বলেন, ''যদি আমাকে ২৪ ঘণ্টাও থাকতে হয় তদন্তের স্বার্থে, আমি অবশ্যই থাকব। আমি সহযোগিতা করছি।''

মঙ্গলবার সায়নীকে যখন নোটিস পাঠানো হয়, তখন তিনি পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের মাঝেরগ্রামে প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। ভোটপ্রচারে থাকাকালীনই তিনি ইডির নোটিসের বিষয়টি জানতে পারেন। ওই দিন রাতে সমাজমাধ্যমে প্রচারে অংশ নেওয়ার ছবিও পোস্ট করেছিলেন। বুধবার তাঁর প্রচারসূচি ছিল পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর বিধানসভা এলাকায়। কিন্তু নোটিসের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সায়নীকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি প্রচারেও যাননি। মঙ্গলবারের পর তাঁকে একেবারে দেখা যায় শুক্রবার সল্টলেকে ইডির দফতর সিজিও কমপ্লেক্সে। তার পর শনিবার আবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

গল্ফগ্রিনে প্রায় একই জায়গায় সায়নীদের দু'টি ফ্ল্যাট আছে। ইডি সূত্রে খবর, এই ফ্ল্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র নিয়ে বুধবার যেতে বলা হয়েছে সায়নীকে। তার মধ্যে একটি ফ্ল্যাটের দাম ৮০ লক্ষ টাকা। ফ্ল্যাটটি কেনার জন্য সায়নী ঋণ নিয়েছেন বলে খবর। ২০ লক্ষ টাকা নগদ দিয়েছিলেন, বাকি ৬০ লক্ষ টাকার জন্য বেসরকারি একটি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেন। সেই নথি দেখতে চেয়েছেন ইডির গোয়েন্দারা। গল্ফগ্রিনের দ্বিতীয় ফ্ল্যাটটি সায়নীর মায়ের নামে কেনা হয়েছে। ইডি সূত্রে দাবি, দু'টি ফ্ল্যাটই কেনা হয়েছিল ২০২০-২১ সালে। ঘটনাচক্রে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সায়নী আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দেন। নিয়োগ মামলার ধৃত তৃণমূলের যুবনেতা (অধুনা বহিষ্কৃত এবং জেলবন্দি) কুন্তল ঘোষের সূত্র ধরেই সায়নীকে তলব করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছিল ইডি সূত্রে। তাঁর ফ্ল্যাট কেনার সঙ্গে কুন্তলের কোনও যোগ আছে কি না, কুন্তলের সঙ্গে সায়নীর কখনও টাকার কোনও লেনদেন হয়েছে কি না, তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন।

প্রচারে নেই সায়নী

তৃণমূলের তরফে গত বুধবার পর্যন্ত পঞ্চায়েত ভোটে তারকা প্রচারকারীদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে সায়নীর নাম ছিল। বৃহস্পতিবার ইদের কারণে তৃণমূলের তারকা প্রচারকারীরা প্রচারে নামেননি। আর শুক্রবার ইডির তলবের কারণে সায়নীকে ওই তালিকায় রাখা হয়নি। তবে শনিবারও তালিকায় তাঁর নাম না-থাকায় জল্পনা শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে সায়নীকে হয়তো আর 'ব্যবহার' করবে না তৃণমূল। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার সায়নীকে হাজিরা দেওয়ার নোটিস পাঠিয়েছিল ইডি। তার পর বুধবারের তালিকায় নাম থাকলেও ওই দিন আর প্রচারে তাঁকে দেখা যায়নি। অর্থাত্‍, এই নিয়ে টানা চার দিন সায়নী ভোটের প্রচারে নেই।

পাঁচ দিনের প্রচার

নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার এক দফায় পঞ্চায়েত ভোট হলে প্রচারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির হাতে আছে আর পাঁচ দিন। নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ হওয়ার কথা। হিসাব মতো বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রচার চলবে। শনিবারের প্রচার তালিকায় সায়নীর নাম ছিল না। রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ এবং বৃহস্পতির মধ্যে বুধবার সায়নীকে ইডির দফতরে যেতে হবে (যদি না তিনি হাজিরা এড়াতে চান)। ধরে নেওয়া যায়, সে দিনের প্রচারেও তিনি থাকবেন না। তার আগে এবং পরে অন্য দিনগুলিতে প্রচারকদের তালিকায় তাঁকে রাখা হবে কি না, সে দিকে নজর থাকবে অনেকেরই।

শনিবার কী বললেন

শনিবার সায়নী জানান, তিনি দলের প্রচারে অবশ্যই যাবেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রচারে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁর কথায়, ''আমি যুব সভানেত্রী। আমি প্রচারে যাব না? আমি শিডিউলটা করছি। প্রচার মানে তো অনেকটা দূরত্বেরও বিষয়। এটা তো কলকাতার ভোট না। সবটাই দেখা হচ্ছে। তবে অবশ্যই প্রচারে যাব। দু'-এক দিনের মধ্যেই যাব। অনেক কর্মসূচি আছে। একটা রোড শো-এ প্রচুর মানুষ আসেন। ফলে আয়োজন করতে সময় লাগে। সবাই ফোন করছে, ডাকছে সারা ক্ষণ। আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চেষ্টা করছি।'' প্রচার তালিকায় তাঁকে আর রাখা হবে কি না, সেই সংক্রান্ত জল্পনা শনিবার উড়িয়ে দেন সায়নী। তিনি বলেন, ''দল আমার পাশেই আছে। আমি প্রচারেও যাব। মমতাদি আমার ফোনের ওয়ালপেপারে নেই, মনের ওয়ালপেপারে আছেন।''

বুধবার কী নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ

শুক্রবার রাতে ইডি দফতর থেকে বেরিয়ে সায়নী জানিয়েছিলেন, তাঁকে আরও কিছু নথি নিয়ে আবার আসতে বলা হয়েছে। বুধবারের জিজ্ঞাসাবাদে ফ্ল্যাট কেনার বিষয়ে তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই নথিই দেখতে চেয়েছেন গোয়েন্দারা। যে ২০ লক্ষ টাকা ফ্ল্যাট কেনার সময় তিনি নগদে দিয়েছিলেন, তার উত্‍স কী, জানতে চাইতে পারে ইডি। সেই সঙ্গে যে বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ফ্ল্যাটের জন্য সায়নী ৬০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন, তার নথি দেখার পরেও তাঁকে কিছু প্রশ্ন করা হতে পারে। কুন্তলের সঙ্গে তাঁর কোনও লেনদেন হয়েছিল কি না, উঠতে পারে সে প্রশ্নও।

সায়নীর বাড়ি-গাড়ি

গল্ফগ্রিনের দু'টি ফ্ল্যাটেই ইডির নজর রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে। একই ঠিকানায় তাঁদের দুই ফ্ল্যাট। দু'টিই কেনা হয় ২০২০-২১ সাল নাগাদ। এ ছাড়া, তৃণমূলের যুবনেত্রী একটি গাড়ি চড়েন। সায়নী অবশ্য দাবি করেছেন, গাড়িটি তাঁর নিজের। তবে তার দিকেও নজর রেখেছে ইডি। সায়নী আর কোনও গাড়ি ব্যবহার করতেন কি না, কুন্তলের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ আছে কি না, কুন্তলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সায়নী গাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য খরচ করেছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে।

সায়নীর কুন্তল-যোগ

সায়নী দাবি করেছেন, কুন্তলের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কোনও যোগাযোগ নেই। রাজনীতির সূত্রেই পরিচয়। ইডি সূত্রে জানা গিয়েছিল, বর্তমানে জেলবন্দি কুন্তলের যোগসূত্র ধরেই নিয়োগকাণ্ডে সায়নীর নাম জড়িয়েছে। এর আগে কুন্তলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। কুন্তলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সায়নীর ছবি (সে ছবির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও সায়নীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছিল, সায়নী বলেছেন, তাঁরা দু'জনে এক মঞ্চে থাকতেই পারেন কারণ তাঁরা একই রাজনৈতিক দলের সদস্য। নিয়োগ মামলায় নাম জড়ানোর পর কুন্তলকে দল বহিষ্কার করেছিল (সূত্রের খবর, সায়নী নিজেই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তদ্বির করেছিলেন দলীয় নেতৃত্বের কাছে। পরে অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে সায়নী সেই খবরকে 'গুজব' বলে উড়িয়েও দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়)।